এক পশলা বৃষ্টির মত করে নদী নেমে এসেছিলো কাল, একলা হয়ে যাওয়া দুপুরের আয়েশ হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে। এক একটা দিনের সাথে মিশে যায় গুঁড়ো গুঁড়ো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির ছোঁয়া। মন জুড়ে, কোল পেতে, এক বুক আকাশ হাতের চেটোয় নিয়ে বসে থাকে কেউ কেউ দিগন্তের চিহ্ন বরাবর। এঘর ওঘর পেরিয়ে যায় হাওয়া, গ্রীষ্ম থেকে বর্ষায়, শরৎ থেকে শীতে। তবুও ফেরা হয়না তার, যে রেখেছিলো চোখের আলোয় অঘ্রাণ-সাঁঝের আকাশ। কোথাও দূরে আরও একলা হয়ে যায় একটুকরো পাখির পালকের ওম মাখা মোমরঙা মন।
“রোদ্দুর আসুক”
তারপর, বিদগ্ধজনেরা বোলবেন, বাঃ কিংবা ছিঃ।
আমি শুধু দেখবো আস্তে আস্তে আলো নেমে আসছে ওই দূরের সুপুরী গাছের পাতা থেকে আমার উঠোনে। বারান্দা পেরিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে আমার ঘর, নিত্যদিনের পুজোর ঘট, কুলুঙ্গিতে রাখা রংচটা পট, বা লক্ষীর ঝাঁপি।
আর তুই দিনান্তে ফিরে আসছিস অনন্ত ক্লান্তি আর অফুরান্ত হাসি নিয়ে সন্তানাদির ওমে।
গেরুয়া চাদর খানি খসে পড়বে বিকেলের মন-কেমনিয়া রূপকথার মতন। হেমন্ত-শেষের কুয়াশার মতন ঘিরে ধরবে মায়া। কিছুতেই সন্ন্যাসে ফিরতে পারবে না আনমন।
অতি ধীরে পরাজিত সম্রাটের মতন মিলিয়ে যাবেন সিদ্ধার্থ, স্বপ্নে বা স্বপ্নের মতন বাস্তবে। চাতকের হাহাকার থেকে আকাশ শুধু ছুড়ে দেবে পরিহাস, অদ্দৃষ্টে ব্যাঙ্গ করবে পরিজন।
আমি শুধু তখন দেখবো, গ্রীষ্ম পেরিয়ে অভিমানী আকুল বর্ষা একটা একটা করে ফুটিয়ে তুলছেসোনা রঙা কাশফুল শরতে। আর সেই ঘরে ফেরা উমা এক হাতে হেমন্তের রাশ টেনে আরেক হাতে এঁকে দিচ্ছে প্রাচীন সেই সব গাছেদের শরীর। শহরে নেমে আসছে সন্ধ্যে। পরিযায়ী ডানায় করে ঘরে আনছে হিমেল রাত।
তারপর, তারও অনেক পর, নদী চাইবে উপত্যকায় ফসল ফলাতে। ফাগুনের ফাগে হোরি খেলবেন শ্যামসুন্দর। আবারও আলো জ্বলে উঠবে তুলসী মঞ্চে, কার চোখে লাগবে কাজল। জোনাকির ডানা থেকে ঘুম ভাঙবে এক একটা তারার; আকাশ জুড়ে কেউ বিছাবে রুপোলি শামিয়ানা।
বিষন্ন নদী তখনও সুন্দর। বিপথগামী হয়ে যেতে চাইবে দিন-ক্ষণ, অব্যক্ত চেহারায় সময়, পরিতৃপ্ত আধেকজন। তিলে তিলে দিন যাপনে স্বার্থ, ভিন্ন থেকে ভিন্নতর অবকাশ।
এক ঘুম স্বপ্নে ফিরে আসবে ছুট ছুট ছোটবেলা, আকাশে লাগবে শারদীয়া রঙ, বাতাসে ভেসে যাবে পুজোর গন্ধ, মা বলে উঠবে, “জানলার পর্দাটা সরিয়ে দে তো, ঘরে রোদ্দুর আসুক।” আর হঠাৎ, ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
শহুরে মন #১
দিন-দরিয়া
এক একটা দিন এক একটা নদীর মতন। কখনও মনের ধারে কাছে ঢেউ ঢেউ আলপনা আঁকা থাকে। কখনও চাঁদের রঙের মতন তুই নেমে আসিস ঢেউদের চোখ ধুয়ে। আনাড়ির আবডালে রূপকথা চুপ থাকে নিশিরাতে ভেসে আসা কামিনী ফুলের গন্ধের মতন। এক একটা দিন বড় বেশি মন টানে সিদ্ধার্থ তোমার ছায়ার কাছে। এইসব ঘর বাড়ি পরিজন আবছায়া হয়ে যায় সেইসব দিনে। তখনও আরেক জন্মের দিকে চোখ-মন অভিশাপ দিয়ে যায় নশ্বর মানুষ-জীবন। ফিরে নিও আরেকবার, সব কিছু ধুয়ে গেলে, পরিধান পরিসর পরবাস, মুক্তি দিও।
হিমেল হাওয়ার মতন দিনেরা সব উড়ে উড়ে ঘুরে ফেরে পাকসাট খেয়ে, তোর আঙুল ছুঁয়ে আমার মনের চারপাশে। আলো আলো মেঘ থেকে নেমে আসে থোকা থোকা গুলঞ্চ ফুলের মতন বাসন্তী আলো। বসন্তেও শরৎ এসে বাসা বাঁধে তোর আমার কোল ঘেঁষে। একরত্তি ঘুমিয়ে নেয় নিষ্পাপ প্রাণ, তোর দুপায়ে মাথা রেখে। নিঃশ্বাস ওঠে পড়ে অবকাশ অক্লেশে। কাজে কাজে আড়চোখে মেখে নেয় এছবি এই-মন। ভরন্ত জীবন্ত মায়ার সংসার। তুই, আমি, আর কিছু নিষ্পাপ চোখ।
আকন্ঠ অপেক্ষার নাম, সিদ্ধার্থ; পায়ে পায়ে উঠে গেছে যে নীলকন্ঠ হিম মেশা ভোরে, কুয়াশায় ঢেকে। অসংখ্য অপত্য স্নেহে পড়ে থাকে এক মুঠো চাবি আর শৈশব। জানলার ধার ঘেঁষে ভেসে যায় আসমুদ্র মেঘ আর পরিযায়ী শীত-ছেঁচা পাখিদের দল। উড়ো চিঠি ফিরে আসে ডাকযোগে; ঈশ্বর তোমাকেও চেয়ে নিতে হয়, ভালোবাসা কিংবা ঠিকানা। নতজানু হয়ে শুধু খুঁজে চলা অনন্তের দিকনিশান। তোমার ঘরেও জ্বলে ঘিয়ের প্রদীপ, কুলুঙ্গিতে লক্ষীর ঝাঁপি।
এক একটা দিন এক একটা গাছের মতন। গেঁথে বসে শিকড় বিছিয়ে মাটির কণায় কণায়।
ভালো থেকো
ঠিক যেমনভাবে বছর ১৫ আগে কোনও সুর চোখ ভেজাতো, মাঝের অনেক ওঠা পড়ার পর এপিঠ ওপিঠ বদল হয়েও কোন এক ভোরে সেই এক সুর যখন একই রকম ভিজিয়ে দেয় চোখ মন আর সুখ, তখন মনে হয় কোথাও কোনোখানে লুকিয়ে থেকে গেছে এক চিলতে না-বদলি আকাশ।
চোখ বন্ধ করলেই ফিরে আসে না-ফেরত সময়। অন্য রকম হয়ে যায় দিন। শীত শুরুর নরম রোদে লাগে ইলশেগুঁড়ির ওম মাখা শরতের আলো।
এসব দিনের জন্য, এসব সুরের জন্য যেন দুর্মূল্য হয়ে ওঠে জীবন। বেঁচে থাকাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে আবার।
এইভাবে ফিরে আসে ভালোবাসা এশহরের আনাচে কানাচ ধরে, ছাতারের ডানায় ভর করে, উবুচ কুবুচ জংলা চারাদের পাতায় পাতায়।
ভালো থেকো ভালোবাসা।
একটা বাড়ি ছিলো। সে বাড়িটার কোনো ছবি নেই। শুধু অনেক ভালোবাসা আকর করে আঁকড়ে জড়িয়ে আছে সেই বাড়িটার সব খানে। উঠোন, ছাত, বাগান, খড়খড়ি জানলায়, কড়িবরগার খাঁজেখাঁজে, কুয়োতলায়, ঠাকুরঘরে, আকাশ পিদিমে, চিলেকোঠায়, জমে আছে পরত পরত ভালোবাসা, রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া মিঠে মিঠে আমসত্ত্বের মতন। সে বাড়িটা বড় ভালো।
আমি কিন্তু দেখতে পাই রোজ, রোজ রাতে সে বাড়িটা আর সব ফেলে আসা বাসাদের নিয়ে বাস করে আমার স্বপ্নের আবাসে।
সে সব বাড়ির গন্ধ বড্ড মন কেমন করা, ঠিক জানি, আম্মার হাতের কপ্পুর-ডালের বড়ি-ধুপ বা দাদুর তৈরি কস্তুরী আতরের মন কেমন গন্ধ।
কোন কোন শীতের দুপুর সেই সব ভালোবাসার টানে এ শহরে উড়িয়ে আনে শীতের পরিযায়ী পাখি, ঘুম ভেঙে উঠে বসে আনমনা মন।
ভালো থেকো ভালো বাসা।